Home বাংলাদেশ কার্টুন কি সাংবাদিকতা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে?

কার্টুন কি সাংবাদিকতা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে?

0

ছোট ফ্রেমে আঁকা কার্টুন কোনও ঘটনা, প্রেক্ষাপট বা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণরূপে তুলে ধরতে পারে। সংবাদপত্রে কার্টুনিস্ট হিসেবে কাজ করার সময়, আমার বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে। একবার, একটি অনুষ্ঠানে, আমার এক বন্ধু আমাকে সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল। কাছের কেউ একজন বাধা দিয়ে বলল, ওহ, আমি তাকে চিনি। তিনি সাংবাদিক নন, তিনি একজন কার্টুনিস্ট!

আমি উভয় পরিচয়েই গর্ব করি। কার্টুনের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসাই আমাকে একজন কার্টুনিস্ট করে তোলে। আর সাংবাদিকতা, বলা বাহুল্য, আমাদের সমাজে একটি অত্যন্ত সম্মানিত পেশা।

কিন্তু কার্টুনিং এবং সাংবাদিকতা কি দুটি পৃথক পেশা? একজন কার্টুনিস্টকে কি সাংবাদিক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে? আমাদের সমাজের উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যেও, এটি একটি প্রশ্ন রয়ে গেছে।

আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে, আমি কিছুটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ কার্টুনকে সাংবাদিকতার একটি রূপ হিসেবে বিবেচনা করে না।

মজার বিষয় হল, এই ভুল ধারণাটি কেবল সাধারণ মানুষের মধ্যেই নয়, সংবাদপত্র শিল্পের অনেকের মধ্যেই বিদ্যমান।

এবং তবুও কার্টুনিং সাংবাদিকতার একটি অত্যন্ত শক্তিশালী রূপ। অবশ্যই, সব কার্টুন সাংবাদিকতা নয়। কার্টুনিংয়ের অনেক শাখা আছে, যেমন কমিক স্ট্রিপ, গ্রাফিক নভেল, ক্যারিকেচার, গ্যাগ এবং আরও অনেক কিছু।

এই সবগুলোই কি সাংবাদিকতার অংশ? মোটেও না। তাহলে, আধুনিক সংবাদপত্রে কার্টুনিংয়ের কোন শাখাকে সাংবাদিকতার একটি শক্তিশালী রূপ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়?

আমেরিকান প্রেস ইনস্টিটিউটের মতে, সাংবাদিকতার চারটি প্রধান লক্ষ্য হল:

১. জনসাধারণকে অবহিত করা
২. ক্ষমতাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা
৩. গণতান্ত্রিক বিতর্ক গড়ে তোলা
৪. জনস্বার্থে কাজ করা

রাজনৈতিক বা সম্পাদকীয় কার্টুনে এই চারটি মূল লক্ষ্যই বিদ্যমান। এই কারণেই কার্টুনিংয়ের এই দুটি শাখা সাংবাদিকতার গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী রূপ হিসেবে স্বীকৃত।

একটি রাজনৈতিক বা সম্পাদকীয় কার্টুন বর্তমান বিষয়, সামাজিক বা রাজনৈতিক ঘটনা বিশ্লেষণ এবং ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপের মাধ্যমে সরকারের ভুল পদক্ষেপের সমালোচনা নিয়ে আলোচনা করে। তাই, কার্টুন গণতান্ত্রিক বিতর্ক তৈরি করতে সাহায্য করে, যা সাংবাদিকতার একটি অপরিহার্য কাজ।

জন হার্ট কার্টুনিস্টের ভূমিকা যথাযথভাবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর ‘পলিটিক্যাল কার্টুনস অ্যান্ড দ্য প্রেস’ বইয়ে তিনি লিখেছেন যে, একজন কার্টুনিস্ট একই সাথে প্রতিবেদক, বিশ্লেষক এবং সমালোচকের ভূমিকা পালন করেন। তাদের আঁকার মাধ্যমে তারা বাস্তবতাকে চিত্রিত করেন।

একটি কার্টুন কেবল হাসির জন্য তৈরি একটি অদ্ভুত স্কেচ নয়। এটি হাস্যরস, একটি বার্তা এবং একটি ঘটনার বিশ্লেষণ বহন করে। একটি কার্টুন জটিল রাজনৈতিক বিষয়গুলিকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে পারে যা লেখার পাতার মাধ্যমেও সম্ভব নাও হতে পারে। যেখানে বাকস্বাধীনতা সীমাবদ্ধ, সেখানে কার্টুন সত্য প্রকাশের জন্য একটি শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে, কারণ তারা জটিল বিষয়গুলিকে পরোক্ষভাবে প্রকাশ করতে পারে।

ঠিক যেমন সমস্ত কার্টুন সাংবাদিকতা নয়, তেমনি সমস্ত কার্টুন রাজনৈতিক বা সম্পাদকীয়ও নয়। একটি ভালভাবে আঁকা ছবি শিল্পের একটি সূক্ষ্ম অংশ, একটি ভাল ব্যঙ্গচিত্র বা একটি মানসম্পন্ন চিত্র হতে পারে।

কিন্তু একটি ভাল কার্টুন কেবল অঙ্কনের গুণমান দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয় না। এটি অবশ্যই একটি বার্তা বহন করে। দর্শক বা পাঠকের এক নজরে তাৎক্ষণিকভাবে সেই বার্তাটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হওয়া উচিত।

একটি ছোট ফ্রেমে আঁকা একটি কার্টুন একটি সম্পূর্ণ ঘটনা, প্রেক্ষাপট বা রাজনৈতিক পরিস্থিতি ধারণ করতে পারে। এই অর্থে, অঙ্কনটি কেবল প্রকাশের একটি মাধ্যম। এটি যে বার্তা প্রদান করে তা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ।

কল্পনা করুন আপনি কিছু লিখেছেন। আপনার হাতের লেখা অসাধারণ সুন্দর। এটি দেখতে আনন্দদায়ক হতে পারে। কিন্তু যদি বিষয়বস্তু বোধগম্য না হয়, যদি অর্থ স্পষ্ট না হয়, তাহলে লেখার সৌন্দর্য খুব একটা কাজে লাগে না।

সুতরাং, সেই সুন্দর হাতের লেখা কমবেশি অর্থহীন হয়ে পড়ে। একইভাবে, আমরা একটি সু-রচিত অঙ্কনের প্রশংসা করতে পারি, কিন্তু যদি একটি কার্টুনে স্পষ্ট বার্তার অভাব থাকে, অথবা যদি এর অর্থ সহজে বোঝা না যায়, তাহলে এটিকে রাজনৈতিক বা সম্পাদকীয় কার্টুন হিসাবে বিবেচনা করা যায় না। বরং, এটিকে শিল্পের একটি অংশ হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হবে।

একটি মননশীল শিল্পকর্ম এবং একটি কার্টুন একই জিনিস নয়। একটি রাজনৈতিক বা সম্পাদকীয় কার্টুনে অবশ্যই একটি বার্তা, একটি বিশ্লেষণ থাকতে হবে এবং এটি সাংবাদিকতার রীতিনীতি অনুসরণ করতে হবে।

অতএব, একজন রাজনৈতিক কার্টুনিস্টের সাংবাদিকতা, রাজনীতি এবং অর্থনীতি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে এবং বর্তমান ঘটনাবলী সম্পর্কে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিম্যান রিপোর্টস’ এবং ‘কলাম্বিয়া জার্নালিজম রিভিউ’ উভয় ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক কার্টুনকে সাংবাদিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

পশ্চিমা বিশ্বের সংবাদপত্রগুলিতে কার্টুন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পশ্চিমা সাংবাদিকতায়, রাজনৈতিক বা সম্পাদকীয় কার্টুনগুলি দীর্ঘদিন ধরেই প্রকাশের একটি শক্তিশালী এবং অনন্য রূপ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

কার্টুন কেবল শিল্পকর্ম নয়। এটি শিল্প, ব্যঙ্গ এবং সাংবাদিকতার একটি উজ্জ্বল মিশ্রণ, যা পাঠকদের কাছে এক নজরে জটিল রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) বলেছে যে সম্পাদকীয় কার্টুন হল সাংবাদিকতার একটি রূপ যেখানে শৈল্পিক দক্ষতা এবং ব্যঙ্গ একত্রিত হয়ে কর্তৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং অন্যায়কে প্রকাশ করে।

এই স্বীকৃতি বিশ্বব্যাপী নিশ্চিত করে যে সম্পাদকীয় কার্টুন গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ।

পশ্চিমা বিশ্বে সম্পাদকীয় কার্টুন আইনত স্বীকৃত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, এগুলি সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর সুরক্ষার অধীনে আসে, যা মত প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়। এমনকি আদালতও স্বীকার করে যে কার্টুনগুলি একটি সৃজনশীল এবং সুরক্ষিত প্রকাশভঙ্গি।

আমাদের দেশে, সংবাদপত্র বা উচ্চতর মানের কার্টুনগুলিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় এবং পাঠকরা সেগুলি পুরোপুরি উপভোগ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সরকার কার্টুন সম্পর্কে অতিরিক্ত সংবেদনশীল।

ফলস্বরূপ, কার্টুনিস্ট এবং সংবাদপত্রের মধ্যে এক ধরণের স্ব-সেন্সরশিপ কাজ করে। এর ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আমাদের সংবাদপত্রগুলিতে কার্টুনের উপস্থিতি লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা একটি হতাশাজনক প্রবণতা।

একজন কার্টুনিস্ট হিসেবে, আমি আশা করি আগামীকালের রাজনীতিবিদরা আরও মুক্তমনা হবেন এবং ভবিষ্যতের সরকারগুলি কার্টুন-বান্ধব হবে। সর্বোপরি, কার্টুনগুলি সরকারের ত্রুটি এবং বোকামিগুলিকে তুলে ধরে, যা একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য অপরিহার্য।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version