ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের তিন মাসের স্থগিতাদেশের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। এপ্রিলে ঘোষিত প্রাথমিক পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে মার্কিন প্রশাসন নতুন পারস্পরিক শুল্ক ঘোষণা শুরু করেছে। এই পদক্ষেপ বিশ্ব বাণিজ্য এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি করবে।
বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের উপর ৩৫ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করা একটি বড় অর্থনৈতিক আঘাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক (RMG) খাতের জন্য। যদিও পূর্ববর্তী মার্কিন শুল্ক হার প্রায় ১৫ শতাংশ ছিল, এখন তা দ্বিগুণেরও বেশি। শুল্কের এই আকস্মিক এবং তীব্র বৃদ্ধি বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির প্রতিযোগিতামূলক সুবিধাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার। শুধুমাত্র ২০২৪ সালে, বাংলাদেশ প্রায় ৮.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে। বর্ধিত শুল্কের বোঝা সরাসরি পোশাক উৎপাদনকারীদের উপর পড়বে এবং লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের উপরও প্রভাব ফেলবে, যাদের বেশিরভাগই নারী।
এর ফলে প্রবৃদ্ধি হ্রাস, কর্মসংস্থান হ্রাস এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধির ঝুঁকিও তৈরি হবে। এই সমস্যাগুলি কেবল অর্থনৈতিক প্রকৃতির নয়; এগুলি সামাজিক পরিণতিও সৃষ্টি করবে।
এই প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপের পেছনের যুক্তি শক্তিশালী নয় এবং এটি কেবল উদ্বেগ বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশ যেমন ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানের উপর কোন শুল্ক হার প্রযোজ্য হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়।
প্রথম পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত ১৪টি দেশের মধ্যে, বাংলাদেশের উপর আরোপিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক সর্বোচ্চ। যদি দেখা যায় যে প্রতিযোগী দেশগুলির উপর শুল্ক হার বাংলাদেশের তুলনায় কম, তাহলে দেশটি প্রতিযোগিতামূলকতার দিক থেকে একটি বড় ধাক্কার সম্মুখীন হবে। ফলস্বরূপ, সরবরাহ শৃঙ্খল-ভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হবে। ক্রেতা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থাও দুর্বল হবে।
এই পরিস্থিতির বৃহত্তর প্রভাব আরও গুরুতর। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলে, মার্কিন ক্রেতারা কম শুল্কযুক্ত দেশগুলির দিকে ঝুঁকতে পারে। বাংলাদেশের বার্ষিক রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি পোশাক রপ্তানির উপর নির্ভর করে। এই ধাক্কা বাংলাদেশকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
আরও উদ্বেগজনক বিষয় হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বিপাক্ষিক শুল্ক আলোচনায় জড়িত বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা ইতিবাচক ফলাফল আনতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। বর্তমান বিশ্ব বাণিজ্য বাস্তবতা এবং পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনীতির আলোকে একটি সুষম চুক্তিতে পৌঁছাতে ব্যর্থতা বাংলাদেশের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চিত এবং অস্থিতিশীল বিশ্ব বাণিজ্য পরিবেশে, বাংলাদেশের মতো দেশগুলি আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর কারণ হল বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য সীমিত। উপরন্তু, আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যবসা এবং বিনিয়োগ পরিবেশ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে রয়েছে এবং কূটনৈতিক প্রভাব সীমিত। এই পরিস্থিতিতে, ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশকে কৌশলগত এবং বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
প্রথমত, রপ্তানি বৈচিত্র্য এবং প্রতিযোগিতা বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এর জন্য পোশাকের বাইরে উৎপাদনশীলতা, প্রযুক্তিগত আপগ্রেড এবং নতুন শিল্প খাতের উন্নয়নে বিনিয়োগ প্রয়োজন। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপীয় বাজার এবং পোশাক পণ্যের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা বাংলাদেশকে এই ধরণের বহিরাগত ধাক্কার জন্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। অতএব, পণ্য এবং বাজার উভয়ের বৈচিত্র্যকরণ এখন আর ঐচ্ছিক নয়, বরং এটি জরুরি।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশকে প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা ত্বরান্বিত করতে হবে। এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার উদীয়মান অর্থনীতির সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি অনুসরণ করা উচিত এবং দক্ষিণ-দক্ষিণ বাণিজ্য (অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলির সাথে) এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করা উচিত। অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার এবং বাণিজ্য বাধা অপসারণের মাধ্যমে, রপ্তানি বাজার সম্প্রসারিত করা যেতে পারে এবং নির্দিষ্ট বাজারের উপর নির্ভরতা হ্রাস করা যেতে পারে।
তৃতীয়ত, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য সংস্কার অপরিহার্য। এর মধ্যে রয়েছে শুল্ক হ্রাস, অ-শুল্ক বাধা হ্রাস এবং আমদানি-রপ্তানি পদ্ধতি সহজীকরণ। এই সংস্কারগুলি কেবল বাণিজ্য আলোচনায় বাংলাদেশের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে না বরং উৎপাদন খরচ কমাতে, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে এবং খাত-ভিত্তিক বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করতে সহায়তা করবে।
বাস্তবতা হল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতিগুলি ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া সময়োপযোগী, কৌশলগত এবং বহুমাত্রিক হতে হবে। দ্রুত অভিযোজন করতে ব্যর্থতা অর্থনৈতিক ঝুঁকিকে আরও গভীর করবে এবং আমাদের ভবিষ্যত সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করবে।