ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লক্ষ্মীপুরের পাঁচ উপজেলার বাসিন্দারা। বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকায় পানিতে আটকে থাকা বাসিন্দাদের মধ্যে ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি, চর্মরোগসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। হাসপাতালগুলোতেও রোগীদের চাপ বেড়েছে।
হাসপাতালে শয্যা স্বল্পতার কারণে রোগীদের মেঝেতেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ে নারী ও শিশুরা। চিকিৎসা সেবা দিতে সমস্যায় পড়ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষসহ চিকিৎসাকর্মীরা।
এদিকে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালসহ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে কলেরার স্যালাইন দ্রবণ, সালফুটামল সিরাপ, হিস্টাসিন ও ডায়রিয়ার অ্যান্টিবায়োটিকের মতো ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারি হাসপাতালে রোগীরা বাইরে থেকে স্যালাইনসহ ওষুধ কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের ১০০ শয্যার ডায়রিয়া ওয়ার্ডে কোনো শয্যা নেই। এক বেডে দুই-তিনজন ভর্তি রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বেডের জায়গা না থাকায় অনেক রোগীকে মেঝেতে বিছানায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। চিকিৎসা কর্মীদের স্বল্পতার কারণে, রোগী এবং তাদের আত্মীয়দের উপচে পড়া ভিড়, এবং ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা পেতে অসুবিধা হয়।
ডায়রিয়া ওয়ার্ডের চিকিৎসা সহকারী ভাই নোমান হোসেন জানান, বর্তমানে ১০ শয্যা বিশিষ্ট ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ৯৫ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। এক-দুজন নার্স দিয়ে এত রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া খুবই কঠিন। ১০ জন ওষুধ দেওয়ার জন্য ডাকে, এবং একজন স্যালাইন ব্যবহার করতে চায়। স্যালাইন দ্রবণ এবং ডায়রিয়ার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিকেরও অভাব রয়েছে। এখন রোগীর স্বজনরা বাইরে থেকে কিনে আনলে আমরা তা দিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যাই।
মান্দারী ইউনিয়নের বাসিন্দা তাসলিমা আক্তার তার সাত মাস বয়সী শিশু মিরাজসহ দুই দিন ধরে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন: দশ দিন ধরে বাড়িতে কোমর-গভীর পানিতে আটকে ছিলাম। টয়লেট এবং ডোবা থেকে নোংরা নোংরা বন্যার জলে একাকী পড়ে থাকে। এখন আমার ৭ মাস বয়সী ছেলের খুব খারাপ লাগছে, তার জ্বর এবং ডায়রিয়া হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার পর আমার অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। পরিস্থিতি শিবিরের মতো।
ছোট মেয়ে তাসুকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মুক্তিগঞ্জের দিনমজুর কর্মী খোকন মিয়াও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, বন্যার কারণে সর্বত্র ডায়রিয়ার মতো রোগ দেখা দিয়েছে। আমার ১০ বছরের মেয়ের খুব খারাপ ডায়রিয়া হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলেও স্যালাইনসহ সব ওষুধ বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনতে হয়। কিছু বললে নার্সরা বলবে ওষুধ নেই।
চর লরেন্স থেকে সামছুন নাহার বলেন, আমাদেরকে আসন দেওয়া হবে না। যাইহোক, ব্যায়াম কক্ষে কোন বিছানা নেই, নোংরা গন্ধ পাওয়া যায়, ভিড় বেশি এবং বসবাসের অবস্থা খারাপ। কোনো চিকিৎসা সহায়তা নেই। সরকারি হাসপাতালগুলো বেসরকারি হাসপাতালের মতোই।
ডায়রিয়া বিভাগের প্রধান লিলু রানী দাস জানান, গত তিন দিনে ডায়রিয়া ও জ্বরে আক্রান্ত তিন শতাধিক রোগী ভর্তি হয়েছেন। যেহেতু রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি, তারা সবাই বন্যা এলাকার বাসিন্দা। শুক্রবার ডায়রিয়ায় ৩২ জন ভর্তি হলেও গত তিন দিনে ডায়রিয়া ও জ্বরে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন বেশি। ১০ জনের জন্য বিছানা খালি নেই। মেঝেতে হাঁটার জায়গাও নেই। চিকিৎসা করা কঠিন।
তার মতে, হাসপাতালগুলোতে কলেরার স্যালাইন দ্রবণ, সালফুটামল সিরাপ, হিস্টাসিন ও ডায়রিয়ার অ্যান্টিবায়োটিকসহ ওষুধের তীব্র সংকট রয়েছে। বিদ্যমান পরিমাণ সমস্ত রোগীদের মধ্যে সমানভাবে বিতরণ করা হবে। রোগীরা এখন তাদের ওষুধ বাইরে থেকে কিনছেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আসে।
এদিকে জেলার ৫টি উপজেলার ৪০০টি বন্যাকবলিত আশ্রয়কেন্দ্রে ডায়রিয়া ও জ্বরের মতো পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে। ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে মেডিকেল টিমের সদস্যরা চিকিৎসা দিলেও তা যথেষ্ট নয়। পশু আশ্রয় কেন্দ্রের বাসিন্দাসহ স্থানীয় বাসিন্দারা অমানবিক জীবনযাপন করে।
লক্ষ্মীপুরের সিভিল সার্জন আহমেদ কবির কালবেলে জানান, বন্যার কারণে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগ শুরু হওয়ার পর থেকে, ৬৪ জন মেডিক্যাল টিমের সদস্য জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র সহ বিভিন্ন এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে।
তার মতে, হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় কলেরার স্যালাইন সলিউশনসহ ওষুধের সংকট রয়েছে। ঘটনাটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। দুই দিনের মধ্যে স্যালাইন দ্রবণসহ ওষুধ সরবরাহ করলে সংকট কেটে যাবে।