“আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই মোটরসাইকেল আরোহী আমাদের মোটরসাইকেলের পেছনে এসে হঠাৎ গুলি চালায়। প্রথম গুলি আমাদের মোটরসাইকেল থেকে পড়ে যায়। তারপর, এক মিনিটের মধ্যে, সন্ত্রাসীরা আলীকে গুলি করে… তারা তাকে পায়ে, পিঠে এবং মাথায় পাঁচবার গুলি করে, তারপর আলী হোসেন হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান।
যশোরে যুবলীগ কর্মী আলী হোসেন (৩০ বছর) হত্যার প্রত্যক্ষদর্শী সোহান হোসেন শেখ (২৪ বছর) ঘটনার কথা বলেছেন। সোহান নামে একজন ট্রাক চালকও আলী হোসেনের সাউন্ড ওয়ার্কের দায়িত্বে ছিলেন। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে শহর থেকে বাড়ি ফেরার পথে সেদার শহরের বাহাদেরপুর জেলার তিনটুরতলা মোড়ে আলী হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই রাতে আলী হোসেন, সোহান ও নয়ন নামে আরেকজন মোটরসাইকেলে করে একসঙ্গে বাড়ি ফেরেন।
মৃত আলী হোসেন সেদার জেলার পশ্চিম পাড়ার বাহাদুরপুর এলাকার আব্দুল রহমান ও আঞ্জাওয়ালা বেগমের ছেলে। সম্প্রতি সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী তওহীদ চাকেরদারের সমর্থক হিসেবে যুবলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তাওহীদ চাকেরদার আওয়ামী লীগের আঞ্চলিক সাধারণ সম্পাদক ও যশোর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহীন চাকেরদারের চাচাতো ভাই।
শুক্রবার ময়নাতদন্ত শেষে বদ জুমা আলী হোসেনের লাশ স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। পুলিশ জানায়, আলী হোসেনের বিরুদ্ধে বিতর্কিত হত্যা, মাদক, প্রতারণা ও দ্রুত বিচার আইনে চারটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। আজ শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বৃদ্ধ বাবা-মা তাদের একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাথর হয়ে গেছে। ৯ মাস আগে বিয়ে হওয়া স্ত্রী ও দুই বোন বাড়ির উঠানে বসে আছে। কেউ কারো সাথে কথা বলে না।
আলী হোসেনের বাবা আবদুর রহমান বলেন, আমার একমাত্র কাজের ছেলে মারা গেছে। স্থানীয় কিসমত নওয়াপাড়া গ্রামের নবাব (৫০) তাকে গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যার বিচার চাই। দুই মেয়ে আর ছেলের বউ নিয়ে এখন আমরা কিভাবে থাকব? আমাদের কে দেখবে? তিনি বলেন, ওই রাতে আলী হোসেনের মোটরসাইকেলে স্থানীয় বাসিন্দা সোহান ও নয়ন ছিলেন। সোহান সব কিছুর সাক্ষী।
নবাব আমাদের পিছনে এসে গুলি চালায়। আমরা মোটরসাইকেল রেখে পালিয়ে যাই। আলী ভাই স্টাম্পে পড়ে গেলেন। নবাব তখন তার পায়ে, পিঠে ও মাথায় পাঁচটি গুলি করে। হাসপাতালে নেওয়ার পথে আলী ভাই মারা যান। এক মিনিটের মধ্যেই সব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
সোহান হোসেন শেখ, আলী হোসেন হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন
আলী হোসেনের বাড়িতে সোহান হোসেন শেখকে পাওয়া যায়। সোহান হোসেন বলেন, “উপজেলায় পৌর নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী তৌহিদ চাকলাদারের সঙ্গে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ছিলাম আমরা। অনুষ্ঠানটি শহরতলীতে হয়েছিল।” কিসমত নওয়াপাড়া গ্রামের নবাবও সেখানে যোগ দেন। জমির লেনদেন নিয়ে নবাবের সাথে আলী ভাইয়ের পুরানো বিরোধ ছিল। আলী ভাই সেই বিরোধ মীমাংসার জন্য নবাবের কাছে ক্ষমা চাইলেন। তারপর প্রায় 12:00। আমরা যখন বাহাদুরপুর-তেঁতুলতলা মোড়ের দিকে পৌছালাম, তখন একটি মোটরসাইকেলে থাকা নবাব আমাদের পায়ে, পিঠে ও মাথায় গুলি করে পালিয়ে যায়। হাসপাতালে নেয়ার পথেই আলী ভাই মারা যান এক মিনিটের মধ্যেই।
ঘটনার পর প্রায় দুই দিন অতিবাহিত হলেও আজ পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। পুলিশ কাউকে গ্রেফতারও করতে পারেনি। কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আলী হোসেনের রেকর্ড অসন্তোষজনক। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ চারটি মামলা রয়েছে। তার পরিবার তার বিরুদ্ধে মামলা করেনি। কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে আলী হোসেনের বাবা আবদুর রহমান বলেন, ‘আলী হোসেনের বিরুদ্ধে হত্যা ও মারামারির দুইটা মামলার কথা আমরা জানি। সে এলাকার মানুষের উপকার করত। এলাকার চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ঘটনার সালিস-মীমাংসাও করত। সঙ্গদোষে ও মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কারণে কিছু দোষত্রুটি থাকতে পারে।’
থানা-পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চতুর্থ ধাপে গত বুধবার অনুষ্ঠিত সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী চেয়ারম্যান প্রার্থী তৌহিদ চাকলাদারের কর্মী ছিলেন আলী হোসেন। তাঁর বিজয় উপলক্ষে বৃহস্পতিবার রাতে উপশহর ই-ব্লক এলাকায় প্রীতিভোজের আয়োজন করা হয়। ওই আয়োজন শেষে মোটরসাইকেলে করে বাড়িতে ফেরার পথে দুর্বৃত্তরা আলী হোসেনের মাথা ও পিঠে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।
পরিবারের লোকজনের দাবি, দুই কারণে আলী হোসেনকে হত্যা করা হতে পারে। এক, আলী হোসেন মাটির ব্যবসা করতেন। এ ব্যবসা নিয়ে আলী হোসেনের সঙ্গে পাশের কিসমত নওয়াপাড়া গ্রামের নবাবের বিরোধ ছিল। মূলত নবাবের ছোট ভাই সিরাজ, আলী হোসেনসহ কয়েকজন ভৈরব নদের মাটি ও বালু তুলে ব্যবসা করতেন। ওই ব্যবসা নিয়ে সিরাজ ও আলী হোসেনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। নবাব তাঁর ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে আলী হোসেনের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। দ্বিতীয় কারণ হলো, সম্প্রতি শেষ হওয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আলী হোসেন বিজয়ী প্রার্থী তৌহিদ চাকলাদারের (মোটরসাইকেল প্রতীক) পক্ষে এবং নবাব পরাজিত প্রার্থী ফাতেমা আনোয়ারের (ঘোড়া প্রতীক) পক্ষে নির্বাচনী কাজ করেন। এটি হত্যাকাণ্ডের কারণ হতে পারে।
এ বিষয়ে তৌহিদ চাকলাদারের সঙ্গে কথা বলতে আজ সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তাঁর এক কর্মী কল রিসিভ করে বলেন, ‘ভাই অনুষ্ঠানে রয়েছেন। এখন কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।’